একসময় যাঁকে কেউ কাজেই নিতে চায়নি, সেই ইছমাইলের অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে এখন ৩১৫ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। অসামান্য মেধার গুণে দেশ-বিদেশে খ্যাতি কুড়ানো ইছমাইল করীম চৌধুরী এমনকি নিজে গাড়ি তৈরির স্বপ্নও দেখছেন। ইছমাইল চীেধুরী মনে করেন, ‘সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ গাড়ি রপ্তানি করবে।’ সেই স্বপ্নের পথ ধরে ধীরে ধীরে এগিয়েও যাচ্ছেন ইছমাইল। অটোমোবাইলের ওয়ার্কশপ ডিলার ক্যাটাগরিতে মাসে সর্বোচ্চ ভ্যাটদাতার খেতাব এখন তাঁর ঝুলিতে। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি একসঙ্গে টয়োটা, লেক্সাস ও মার্সিডিস বেঞ্জের সনদপ্রাপ্ত। তাঁরই ঝুলিতে লেক্সাসের এশিয়ার শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী পদক।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম বাড়ি। বাবা করীম হোসেন। বড় তিন ভাই উচ্চশিক্ষার পথে হাঁটলেও ইছমাইল পা বাড়ান হাতে-কলমে শিক্ষার পথে। এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। বিষয় পাওয়ার টেকনোলজি। কৃতিত্বের সঙ্গে কোর্স সম্পন্ন করলেও বিপাকে পড়েন ১৯৯৮ সালে ইন্টার্ন করা নিয়ে। অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, প্রায় সবাই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে নাভানায় ইন্টার্ন করার সুযোগ পান। দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে নাভানা গ্রুপ ইছমাইলকে নিয়মিত কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়।
চাকরি পাওয়ার পর ইছমাইল করীম চৌধুরী আরো বড় স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। দিনে অফিস, রাতে নীলক্ষেত থেকে কম টাকায় কেনা পুরনো বই কিনে রাতে গাড়ির ম্যানুফ্যাকচারিং আত্মস্থ করতেন। বাংলাদেশ যখন নেট দুনিয়ায় প্রবেশ করে তখন ইছমাইল সাইবার ক্যাফেতে বসে বিভিন্ন গাড়ি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন। এভাবে ধীরে ধীরে অন্যদের ছাড়িয়ে পৌঁছে যান অনন্য উচ্চতায়।
নাভানায় থাকাকালে পরীক্ষা দিয়ে টয়োটা টেকনিশিয়ান হিসেবে সনদপ্রাপ্ত হন, যা দেশের জন্য ছিল একটি রেকর্ড। কারণ আগে অনেকেই এই পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস মার্ক পেতে ব্যর্থ হন। এরপর ধাপে ধাপে প্রো-টেকনিশিয়ান ও মাস্টার টেকনিশিয়ান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ইছমাইল চৌধুরী। টয়োটা কম্পানি তাঁর দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে লেক্সাস গাড়ির ওপর উচ্চতর ট্রেনিংয়ে জন্য বাহরাইন (তৎকালীন এশিয়ার ট্রেনিং সেন্টার) পাঠায়। এশীয় অঞ্চলের সেই ট্রেনিংয়ে ১৭ প্রতিযোগীর মধ্যে পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দেন। তাঁর এ সাফল্যে অভিভূত হয়ে লেক্সাস ইছমাইলকে বাংলাদেশের ইনচার্জ বানিয়ে দেয়। এত দিন লেক্সাস গাড়ির জটিলতা হলে দুবাই কিংবা সিঙ্গাপুর থেকে টেকনিশিয়ান আনতে হতো! সেই যুগের অবসান হয় ইছমাইল চৌধুরীর হাত ধরে।
ইছমাইলকে তখনো টানছে আরো বড় কিছু করার স্বপ্ন। সাড়ে পাঁচ বছরের মাথায় নাভানার পাট চুকিয়ে যোগ দেন র্যাংগস গ্রুপের র্যানকন মটরসে। এবার হাইটেক ডায়াগনসিস কোর্স সম্পন্ন করে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সনদ তালিকায় নিজের জায়গা করে নেন ইছমাইল। এখানে একটি মজার ঘটনা ঘটে তাঁর জীবনে। ইছমাইল চৌধুরী বলেন, “মার্সিডিজ বেঞ্জ কম্পানির একটি হাইপ্রফাইল টিম বাংলাদেশ সফরে আসে ডিলার মুল্যায়ন করতে। প্রথমে তারা ম্যানেজারের মৌখিক পরীক্ষা নেয়, জানতে চায় তাঁর কোন কর্মীটি পরীক্ষায় প্রথম হবে? জবাবে ম্যানেজার প্রদীপ কুমার অন্য দুজনকে এগিয়ে রেখে আমাকে রাখেন তৃতীয় নম্বরে। ম্যানেজার সেদিন বলেছিলেন, ‘বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার যিনি, তিনিই প্রথম হবেন, আরেকজন দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, তাই তিনি দ্বিতীয় হবেন। ও তো (ইছমাইল) মাত্র ছয় মাস হয় এখানে এসেছে!।’ সেই পরীক্ষায় আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলাম। এতে মালিক পর্যন্ত আমার নাম পৌঁছে যায়।”
ইসলাম বলেন, ‘এ পর্যায়ে চিন্তা করলাম ওপরে উঠতে গেলে দক্ষতার পাশাপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হবে। তাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হই। দিনে চাকরি আর রাত জেগে পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করি। ল্যানকনের চাকরির দেড় বছরের মাথায় প্যাসিফিক মোটরস থেকে অফার আসে। আমি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে প্যাসিফিক মোটরসের মালিক র্যাংগস গ্রুপে ফোন করে আমাকে নিযে যান। যোগদান করেই জাপানে গেলাম ট্রেনিং নিতে। ৪৫ দিনের এওটিএস মেইনটেন্যান্সে ট্রেনিং করি। এন-স্টেপ-২ পরীক্ষায় প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে উত্তীর্ণ হই। এরপর ইউকে থেকে ইলেকট্রিক্যাল ও হাইব্রিড গাড়ির ওপর বিশেষ ট্রেনিং গ্রহণ করি।। এভাবে বিভিন্ন সময়ে আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মোট ১২টি উচ্চ পর্যায়ের কোর্সে অংশ নেন ইছমাইল।
এই পর্যায়ে এসে জীবনে আরো একটি বড় বাঁক আসে স্বপ্নবিলাসী এই মানুষটির। ইছমাইল বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই মনে স্বপ্ন অঙ্কুরিত হচ্ছিল নিজে কিছু করা। কারণ দেখতাম, এই সেক্টরটি এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন। অন্ধকারে অল্প আলোও নজরে আসে। চার বন্ধু মিলে ২০০৮ সালে তেজগাঁওয়ে একটি গ্যারেজ দিই। তখন আমার কাছে বলতে গেলে কিছুই জমা ছিল না, ধারদেনা করে অংশীদারি নিই। বছরখানেকের মধ্যে অনেক গাড়ি আসতে থাকে গ্যারেজে। গাড়ির লাইন ওয়ার্কশপ ছাড়িয়ে রাস্তা পর্যন্ত চলে যায়। আরো জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু পার্টনাররা পিছিয়ে থাকেন। এতে টানাপড়েন শুরু হলে তাঁদের বলি হয় বিনিয়োগ বাড়ান, না হয় আরো পার্টনার নেন; তা না হলে আমার শেয়ার আপনারা কিনে নেন। শেষ পর্যন্ত বড় ভাইদের সঙ্গে পরামর্শ করে ২০০৯ সালে নিজের মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপের যাত্রা শুরু করি। বর্তমানে এক লাখ স্পেসের ওয়ার্কশপ আমাদের। আমরাই প্রথম এক ছাতার নিচে সব ধরনের গাড়ির সার্ভিসিং নিয়ে এসেছি। গ্রাহক সেবার মাধ্যমে কয়েক বছরেই আমরা (লোকাল ওয়ার্কশপ ক্যাটাগরিতে) সর্বোচ্চ ভ্যাটদাতার খেতাব অর্জন করেছি। শুধু কোনো এক মাসে নয়, ধারাবাহিকভাবে এই অর্জন ধরে রাখতে পেরেছি শুধু গ্রাহক সন্তুষ্টির মাধ্যমে।’
সাফল্যের মূলমন্ত্র কী—এমন প্রশ্নের জবাবে এই তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, ‘মাল্টিব্র্যান্ডের মূলমন্ত্র হচ্ছে, কেউ এককভাবে নয়, প্রত্যেকেই মালিক। কর্মী-মালিকে কোনো ভেদাভেদ নেই। দুপুরের খাবার, বিকেলের নাশতা সবার সমান। সবাই এক টেবিলে বসে দুপুরের খাবার সারেন। কর্মীদের কল্যাণে প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে, অনেকেই রাজি হচ্ছিলেন না, আমরা তাঁদের বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। করোনাকালেও কাউকে ছাঁটাই করা হয়নি, যাঁরা গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁদেরও ৫০ শতাংশ বেতন দিয়েছি। যে কারণে কর্মীরা মাল্টিব্র্যান্ডকে আপন করে নিয়েছেন।’
গ্রাহকসেবা বিবেচনায়ও ইছমাইল স্থাপন করেছেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি বলেন, ‘এই সেক্টরে বড় একটি অন্ধকার অংশ রয়ে গেছে! আমরাই প্রথম কাল্পনিক ভাউচার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছি, যা বিল আসবে তা-ই ভাউচার, ড্রাইভার কিংবা কারো প্ররোচনায় বেশি বিল করা হয় না। এতে অনেকটা বিড়ম্বনাও পোহাতে হয়েছে, অনেক করপোরেট গ্রাহক ছুটে গেছে আমাদের কাছ থেকে, কিন্তু আমরা ছিলাম অবিচল, তার ফল পেতে শুরু করেছি। অনেকেই আবার ফিরে এসেছে তাদের ভুল বুঝতে পেরে।’
ইছমাইল বলেন, ‘আমরা যেসব সার্ভিস দিচ্ছি, ছয় মাসের মধ্যে যদি একই সমস্যা হয় তাহলে ফ্রি সার্ভিসিং করা হয়। সেবা নেওয়া গাড়িগুলোর ডাটাবেইস সংরক্ষণ করা হয়। একটি গাড়ি কয়েক বছর পরে এলেও এক ক্লিকে তার আদ্যোপান্ত পাওয়া যাবে। এতে করে গাড়ির সার্ভিস সহজ হবে। জোর দেওয়া হয় সঠিক ডায়াগনসিসেও। তাই উন্নত ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে গড়া হয়েছে ওয়ার্কশপ। টেকনিশিয়ানদের নিয়মিত ট্রেনিংয় দিয়ে আপডেট করা হয়।’ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, ‘একসময় লেক্সাস, মার্সিডিজ বেঞ্জের মতো ব্র্যান্ডগুলোতে সমস্যা হলে বিদেশ থেকে টেকনিশিয়ান আনতে হতো। এতে লাখ লাখ টাকা খরচ হতো, সেই সমস্যা দূর করেছি। এখন বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করতে হচ্ছে। আশা করছি, একসময় বাংলাদেশে তৈরি গাড়ি বিদেশে রপ্তানি হবে।’
ইছমাইল বিশ্বাস করে, কঠোর শ্রমই সাফল্যের মূলমন্ত্র। বিশাল ওয়ার্কশপের মালিক হয়েও বস বনে যাননি। এখন সকাল ৭টায় অফিসে এসে দিনের কাজ শুরু করেন, চলে গভীর রাত পর্যন্ত। দুপুরে কর্মীদের সঙ্গে এক টেবিলে বসেই খাবার সারেন। তাই কখনোই কোনো কাজে পিছিয়ে যেতে হয়নি। অনেক সুহৃদ এগিয়ে এসেছেন ত্রাতা হিসেবে। মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপ এখন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত মাল্টিব্র্যান্ড অটোপার্টস, মাল্টিব্র্যান্ড ইনফোটেক এবং মাল্টিব্র্যান্ড মিত্সুবিশি সুনামের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইছমাইল চৌধুরী মনে করেন, এই শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ লোক তৈরি করতে পারলে যেমন দেশে চাহিদা রয়েছে, তেমনি বিদেশেও উচ্চ বেতনের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তাঁর ওয়ার্কশপেই কেউ কেউ লক্ষাধিক টাকা বেতন পাচ্ছেন।
মেধাবী এই গাড়ির প্রযুক্তিবিদ বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া যেমন গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি ব্যাপক প্রসার ঘটেছে অটোমোবাইল সেক্টরের। সারা দেশে ছোট-বড় ৩৫ হাজারের মতো ওয়ার্কশপ রয়েছে। এতে প্রায় ১২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।