মোঃ মোকাররম হোসাইন
জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধিঃ
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌর এলাকার শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে আলুর চিপস শুকানো হচ্ছে। দুই মাস থেকে গ্রামটির চার শতাধিক বাড়ির প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে আলু সেদ্ধ করার কাজ। সেই সেদ্ধ আলু ঝুরি ঝুরি করে গোলাকার করে কেটে বাড়ির উঠানে, নদীর পাড়, রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় রোদে শুকানো হচ্ছে। শুকানো আলু ভেজে চিপস তৈরি করে বিক্রি করেন গ্রামের মানুষ। গ্রামটির নাম শ্রীকৃষ্টপুর। গ্রামটি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌরসভা এলাকায় অবস্থিত।
বর্তমানে গ্রামের শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সী মানুষ চিপস প্রস্তুত কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গ্রামের বসবাসকারী ৮৫ শতাংশ মানুষই আলুর চিপস তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের সারা বছরের আয়ের একমাত্র অবলম্বন এ কাজ। আলুর চিপস তৈরির মাধ্যমে এসব পরিবারের অভাব দূর হয়েছে। হাতে তৈরি করা আলুর চিপসের ব্যাপক চাহিদা স্থানীয় বাজারে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব আলুর চিপস রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় যে , শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে কেউ আলু সেদ্ধ করছেন, আবার কেউ সেদ্ধ আলু ঝুরি ঝুরি করে গোলাকার কাটছেন। কাটা আলুর ফালিগুলো তুলসী গঙ্গা নদীর পাড়, বাঁধ, রাস্তা, পুকুর পাড়ে রোদে শুকাচ্ছেন।
শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামের বাসিন্দা আবু রায়হান বলেন, ‘আমাদের গ্রামের মোটামুটি সবাই আলুর চিপস তৈরির কাজ করেন। এই মৌসুমে হাজার-হাজার মণ ক্যাডিনাল জাতের আলুর চিপস তৈরি করা হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আলুর চিপস তৈরির কাজ চলে। গ্রামের সবাই আলু চিপস তৈরির কাজ করে সারা বছর সংসার চালান।’
গ্রামবাসীর ভাষ্য, গ্রামে চার শতাধিক পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে ১০/১২টি পরিবার বাদে সবাই আলুর চিপস তৈরি করে। মৌসুমি এ ব্যবসার আয়ে সারা বছর সংসার চলে। কত বছর আগে গ্রামটি আলু চিপস তৈরি হচ্ছে তা কেউ বলতে পারেননি। অনেকেই বাপ-দাদার পেশা মনে করে আলুর চিপস তৈরি করছেন। গ্রামটিতে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মণ আলু সেদ্ধ করা হয়।
আলুর চিপস তৈরির কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বলেন, ক্যাডিনাল জাতের আলু চিপস তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। অন্য জাতের আলু দিয়ে চিপস তৈরি হলেও তেমন স্বাদ মেলে না। বাজার থেকে প্রতি মণ ক্যাডিনাল আলু ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা কেনা হয়। সেই আলু সেদ্ধ করার পর গোলাকার করে কেটে রোদে শুকিয়ে ভেজে চিপস তৈরি করা হয়। পাঁচ মণ ক্যাডিনাল আলুর এক মণ চিপস হয়। প্রতি মণ চিপস সাড়ে চার হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। মহাজনেরা এসে আলুর চিপস নিয়ে যান। আবার তাঁরা নিজেরাই ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আলুর চিপস সরবরাহ করেন। এই চিপস তৈরি করতে বেশ পরিশ্রম হয়। তবে আজ পর্যন্ত কেউই লোকসান করেননি। যেসব ব্যবসায়ীর পুঁজি বেশি, তাঁরা বেশি করে আলু কিনে চিপস তৈরি করে সংরক্ষণ করেন। তাঁরাই বেশি লাভ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা রাসেল হোসেন বলেন, ‘আমাদের গ্রামটি আলু ভাজার গ্রাম বলে অনেক আগ থেকে পরিচিতি। গ্রামের প্রায় সবাই আলুর চিপস তৈরির ব্যবসা করেন। প্রতিবছর এখানে হাজার হাজার মণ আলু চিপস তৈরি হয়।’
১২৮ মণ আলু কিনে চিপস তৈরি করেছেন মুকুল হোসেন। এক মণ শুকানো চিপস তৈরি করতে তাঁর দুই হাজার টাকার মতো খরচ হয়। সময় লাগে দুই দিন। আর এক মণ চিপস বাজারে পাইকারি বিক্রি হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। দুই দিনে লাভ হয় দেড় হাজার টাকা। আর তেলে ভেজে হাতে বিক্রি করলে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা লাভ হয়। সাধারণত তিনি তেলে ভেজে হাতে বিক্রি করেন। ‘বাপ–দাদার এ ব্যবসা এখনো আমরা করে আসছি। এ ব্যবসা করে আমরা পরিবারের উন্নতি করেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া করছে। আমাদের বাড়িঘরের অবস্থাও উন্নতি হয়েছে’—এমন মন্তব্য করেন মুকুল হোসেন।
শ্রীকৃষ্টপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুশান্ত কুমার ঘোষ বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত পুরো গ্রামজুড়ে আলুর চিপস তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। পরিবারের সবাই কাজ করেন। এ কারণে দুই মাস বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কমে যায়।
শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে আলুর চিপস তৈরির ফলে খাদ্য হিসেবে আলুর বহুবিদ ব্যবহার হচ্ছে। সরকার যদি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দেয়, তাহলে এসব পরিবার গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে।
আলুর চিপস একটি লাভজনক ব্যবসা বলে মন্তব্য করেন আলু চিপসের কারিগর হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, আলুর চিপস সংরক্ষণ করার জন্য এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আলু কিনতে হয়। সরকার যদি তাঁদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে, তাহলে উপকার হয়। তিনি এবার সাড়ে এক হাজার মণ আলুর চিপস তৈরি করছেন।
আক্কেলপুর পৌরসভার মেয়র মো. শহিদুল আলম চৌধুরী বলেন, শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে আলুর চিপস তৈরির ফলে খাদ্য হিসেবে আলুর বহুবিদ ব্যবহার হচ্ছে। সরকার যদি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দেয়, তাহলে এসব পরিবার গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে।
আক্কেলপুর উপজেলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, আলুর বহুবিদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অন্য দিকে আলু চাষিদের উৎপাদিত আলুর ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত হবে।